আমার আব্বা শ্রেষ্ঠ আব্বা

শাহনাজ পারভীন

শাহনাজ পারভীন

“তুই ছিলি লাউ ফুলের মতো ফর্সা। ধবধবে। তোর যখন জন্ম হলো নোয়া কাকা (আমার আব্বা) সঙ্গে সঙ্গে ময়রার বাড়ির সব রসগোল্লা এনে হাজির। তিন কড়াই। কাকা কী খুশি। বাব্বারে! জানিস তো, তুই হবার আগে নোয়া কাকীর আরও দুটি মেয়ে হয়েছিল। একজনের নাম কোহিনুর।  সে মারা গিয়েছিল টিটেনাসে। চার বছর বয়সে। তারও আগে আরেকটি মেয়ে। জন্মের সময়ই সে ছিল মৃত। তারপর তোর মেজোভাই। আর কাকার ছিল মেয়ের শখ। তাই তোর জন্মের সময় নোয়া কাকা নোয়া কাকীকে তাঁর গ্রামে বাপের বাড়ি ভাটরায় পাঠায়নি। এইখানে কামারখালীতে রেখেছে। তোর নানিও এই প্রথম এই বাড়িতে এসে এতদিন থাকলো। যাক, নোয়া কাকার শখ মিটলো।”

এই কথাগুলো আমি বুদ্ধি হবার পর থেকেই আমার চাচাতো বড় বোনের মুখে বার বার শুনে আসছি।  

এবং আজীবন দেখে এসেছি–আমার জন্য আমার আব্বার অন্য এক মায়ার ছড়াছড়ি। আদরের বাড়াবাড়ি।
আব্বার চোখে অন্য এক দৃষ্টি  অন্য এক আলাদা প্রশ্রয়। যার কারণে আমার কবি হয়ে ওঠা। ছোট বেলায় দেখতাম আব্বা তার বন্ধুদের সাথে আমাকে নিয়ে গল্প করতেন–
"– দেখিস, বড় হয়ে মেয়েটি আমার কবি হবে।
আব্বার বন্ধুরা হেসেই খুন!
–বলিস কী, মানুষেরা বলে,  বড় হলে আমার ছেলে ডাক্তার হবে,  ইঞ্জিনিয়ার হবে। আর তুই কিনা বলছিস, বড় হয়ে তোর মেয়ে কবি হবে!
–হুম। বলছি তো, দেখে নিস। যদি বেঁচে থাকি আমিও।"

আজও চোখ বন্ধ করলেই সেইসব উজ্জ্বল বিকেলগুলো  আমাকে আপ্লুত করে অহর্নিশি। খুঁজে মরি কি যে!

আমার আব্বা ছিলেন সহজ সরল একজন প্রাঞ্জল মানুষ।  তিনি ছিলেন অল্প শিক্ষিত, কিন্তু জীবন ঘনিষ্ঠ পণ্ডিত। ছিলেন দূরদর্শী ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন জীবন সম্পর্কে উচ্চ ধারণা সম্পন্ন একজন সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব। আমাদেরকে তিনি অবাধ স্বাধীনতা দিতেন। সব সময় বড় মনের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবার চেষ্টা করেছেন। আব্বা ছোটবেলা থেকেই আমাদের হাতে সব সময় প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত টাকা পয়সা দিতেন। এই নিয়ে যদি মা, চাচীরা আব্বাকে কিছু বলতেন,  আব্বা তার উত্তরে বলতেন, আগে বাচ্চাদেরকে খরচ করা শেখাতে হবে, নইলে তারা আয় করা শিখবে কিভাবে? সত্যি তো! এটা আমাকে সব সময় ভাবায়, এবং নিজেকে ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

আমার আব্বা ছিলেন ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ের কাজে আব্বাকে প্রায়ই বিভিন্ন শহরে যেতে হতো। আমার আব্বার পছন্দ জ্ঞান ছিলো উচ্চ মার্গের, সকলের চেয়ে আলাদা। আমার আব্বা কেনাকাটার ব্যাপারে খুব সৌখিন ছিলেন। কামারখালীর অন্য সবার মতো কামারখালী বাজার থেকে আমাদের জন্য কেনাকাটা করতেন না।  আব্বা সব সময় জেলা শহর  ফরিদপুর থেকে কেনাকাটা করতেন। ওই সময় প্রথম এদেশে নিক্সন মার্কেটের প্রচলন হয়। তখন আমাদের এলাকার বেশির ভাগ ছেলে মেয়েরা নিক্সন মার্কেটের পুরনো সোয়েটার পরলেও আব্বা আমাদের জন্য জেলা শহর থেকে ব্রাণ্ডের নতুন কোট কিনে আনতেন। কখনো পুরনো সোয়েটার কিনতেন না। আমাদের স্কুলের ব্যাগ, জামা, জুতা, সবই ছিল সবার চেয়ে অন্য রকম সুন্দর। ঈদের সময় আব্বা সাদা বড় কাগজের উপরে আমাদের সব ভাইবোনের পা রেখে পেন্সিল দিয়ে দাগ কেটে পায়ের মাপ নিয়ে ফরিদপুর থেকে জুতা স্যাণ্ডেল নিয়ে আসতেন। রেডিমেড জামা কেনা সত্ত্বেও  আমাদের সবার জন্য গাট ধরে থান কাপড় নিয়ে আসতেন। আমাদের দুই একজন চাচাতো ভাইবোনসহ দর্জিবাড়িতে জামা কাপড়ের মাপ দিতাম। ঈদের আগে মাঝে মাঝেই দলবেঁধে সবাই দোকানে যেয়ে সেই জামা কাপড়ের খোঁজ নিয়ে আনন্দ পেতাম।

আব্বাকে নিয়ে আমার হাজারো স্মৃতি রয়েছে। তার মধ্য থেকে দুই একটি নষ্টালজিক  স্মৃতি রোমন্থন করছি। তখন আমি বেশ ছোট। মা চলে গেছেন মাস খানিক। এর মধ্যে আমার খুব  আমাশয় হলো। রক্ত আমাশয়। আমাশয়ের সাথে তাজা রক্ত পড়তো। আমাদের পাশের বাড়ি এক চাচী ছিলেন, আমরা তাকে জুলেখার মা চাচী বলতাম। খুব মানবিক এবং জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। টোটকা ওষুধ দিতেন তিনি। সারা পাড়ার যার যাই হোক না কেন, উনি বিভিন্ন গাছ গাছড়া দিয়ে ওষুধ দিতেন। অসুখ বুঝে দোয়া দুরুদ পড়ে ঝাঁড়, ফুক করতেন। কখনো কখনো তেল পড়া, পানি পড়াও দিতেন। সেই চাচী আমাকে সিদ্ধ কাঁচা কলা খেতে বললেন এবং নানান রকম গাছ গাছড়া আর থানকুনি পাতা দিয়ে দুটি বিশেষ ওষুধ বানিয়ে দিলেন। দুই দিন খেলাম, কিন্তু সারলো না।

শুরু হলো পেট ব্যথা। আব্বা রাতে বাড়িতে এসে সবকিছু শুনে কি রাগ? কেন, ওই ওষুধ খেয়েছি? সেই রাতেই কামারখালী বাজারে ঘুমন্ত ডাক্তারকে (মেঘা ডাক্তার) ডেকে তুলে ওষুধ নিয়ে এলেন। নিজে গরম পানি করে ওষুধ বানিয়ে খাওয়ালেন। আমাদের ওই এলাকায় তখন এটাস বাথরুম ছিলো না কারো। আমাদেরও ছিলো না। শোবার ঘর থেকে বেশ দূরে উঠোন পেরিয়ে বাথরুম। আব্বা আমাকে রাতে বার বার বাথরুমে নিয়ে যাচ্ছিলেন। অনেক বার বাথরুম করার পর যখন কাহিল হয়ে গেলাম আমি, তখন আব্বা আর মাটি থেকে বেশ উপরে সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাথরুমে বসতে না দিয়ে উঠোনের এক পাশে অন্ধকারে মাটিতে বসিয়ে দিলেন।

হঠাৎ শুরু হলো ঝড় বৃষ্টি। কিন্তু আমার খুব পেট ব্যথা করছে, উঠতেও পারছি না। তখন আব্বা আমাকে ঝড় বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে একদম আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন। আব্বার পরনের লুঙ্গি একটু উঁচু করে চারপাশ দিয়ে ছাতার মতো করে আমাকে পুরোপুরি ঢেকে ফেললেন। আমাকে ঝড় বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করে নিজে পুরোপুরি বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ভিজে গেলেন।

তারপর যখন আমার আবারও বাথরুম লাগলো তখন আমাকে বৃষ্টি থেকে বাঁচানোর জন্য ঘরের মধ্যে একপাশে পুরনো বস্তা বিছিয়ে দিলেন। আব্বা ঠাঁই বসে থাকলেন চেয়ারে। সেই রাতেই আব্বা নিজ হাতে বস্তা বাইরে ফেলে দিয়ে ঘর পরিষ্কার করে রাখলেন। যতক্ষণ না আমি ঘুমিয়েছিলাম, ততক্ষণ আব্বা সেদিন জেগে ছিলেন। সেই রাতের কথা ভুলতে পারিনি এখনো।

আর একটি কথা প্রায়ই মনে পড়ে। বিকালে আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে আব্বার সাথে বাজারে যেতাম। আব্বা যখনই বাড়ি থেকে বের হতেন, তার একটু আগে আমরা বাড়ির মূল গেট পেরিয়ে বাহির বাড়ির তাল গাছ তলায় আব্বার জন্য  অপেক্ষা করতাম। মা ঘরে আছেন, তাই মায়ের চোখ এড়িয়ে আমরা এটা প্রায়ই করতাম। মা টের পেতেন না। আমি আব্বার হাত ধরে বাজারে যেতে যেতে  সারাদিনের জমানো গল্প করতাম। আব্বা আমাকে, আমাদেরকে বাজারে নিয়ে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দিতেন। আমরা আবার চুপিচুপি বাড়ি ফিরে আসতাম।

আব্বাই আমাকে রাত জেগে পড়াশোনা করার অভ্যাস করিছিলেন। আব্বা প্রতিদিন রাতে বাড়ি ফেরার সময় মিষ্টি, পাউরুটি, ফলমূল নিয়ে আসতেন। আমার ঘরটি ছিল সবার আগে। আব্বা বাড়িতে ঢুকেই আগে আমাদের খাবারের প্যাকেটটা আমার হাতে দিয়ে ছোট ভাই বোনের প্যাকেটটা মায়ের ঘরে নিয়ে যেতেন। আব্বা বলতেন, গরম পাউরুটি, রসগোল্লা খাও। খেয়ে আবার পড়তে বসো। আহা! এমন স্মৃতি ভোলা যায়? বার বার মনের মনিকোঠায় আদর মাখা আব্বার কণ্ঠ ঝিলিক মারে।

আমার আব্বা চিরকাল শান্ত স্বভাবের ছিলেন। কখনো কারো সাথে উঁচু কণ্ঠে কথা বলেন নি। অকারণ মনোমালিন্য করেননি। কারো বিরক্তির কারণ হননি। খুব ছোট কণ্ঠে গভীর কথা বলতেন। সব সময় বলতেন — বোবার শত্রু নেই। যেই মা ঘরে আছেন, সেই মায়ের নানান অভিযোগ, অনুযোগে আব্বা শুধু একটি কথাই বলতেন– তুমি আমার সাথে ঝগড়া করো তো, দেখি কেমন পারো? তোমাকে আমি রসগোল্লা খাওয়াবো। একথা বলেই আব্বা পকেট থেকে টাকা বের করে দিতেন। নাও টাকা, রসগোল্লা আনাও। আমার সাথে ঝগড়া করো, দেখি কেমন পারো? তোমার পুরষ্কার দেবো। মা অবশেষে রাগ করে, বিরক্ত হয়ে চুপ করে থাকতেন।

আব্বাকে ঘিরে আমার আর একটি ছোট ঘটনা আপনাদেরকে বলবো। যেদিন আমার বিয়ে ঠিক করে যশোর থেকে অনেক রাত করে আব্বা বাড়ি ফেরেন, সেদিন বাড়ি ফিরে আমার সাথে রাতে কোনো কথা বলেন নি আব্বা । পরদিন খুব সকালে আমার সাথে দেখা না করেই বের হয়ে যান। আমিও অভিমানে দূরে দূরে থেকেছি।

আব্বার প্রতি সেই আমার প্রথম অভিমান হলো। সত্যি বলতে সেই আমার প্রথম অভিমান। জীবনের চলার পথের অনেকটা সময়ে সত্যি আব্বার প্রতি কোনদিন আমার কোনো অবস্থায়ই কোনো অভিমান হয় নি। বরং সব সময় আব্বা আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন বলে আব্বাকে অভিযোগ শুনতে হতো। কিন্তু আজ আমার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আব্বার প্রতি অভিমানে আমি বিমূঢ় হয়ে রইলাম।

আজ আব্বা সব মুরব্বিদের নিয়ে আমার বিয়ের কথা পাকা করতে যশোর গেছেন। যদি ছেলেদের  সবকিছু পছন্দ হয়, তবে বিয়ে ফাইনাল করবেন। কিন্তু একেবারে দিন ধার্য্য করে আসবেন, তা আমি বুঝতে পারি নি। বেশ রাত করে যখন সবাই বাড়িতে ফিরে এসে ও বাড়ির গল্প সাত মুখে বলছিলো, তখন আমি শুধু আব্বাকে খুঁজছিলাম। কিন্তু আব্বা কি এক অজ্ঞাত কারণে অত রাতেও সবার সাথে বাড়ি ফিরে  আসেন নি। আমি কারো মুখ থেকেই কিছু শুনতে চাই নি। চুপচাপ নিজেদের ঘরে চলে আসি। নিজেদের মানে পাঁচ ভাইবোনের একটি ঘর।

ঘর মানে একটি রুম। ভাইয়ের বিয়ের আগে নতুন বানানো একটি পাকা ঘরের দুটো রুমের একটি।  একটিতে বড় ভাই, ভাবী থাকেন, আর একটিতে আমরা চার বোন এক ভাই থাকি। আমি ওদের মধ্যে বড়। আমার ছোট তিনটি বোন আর একটি ভাই।  বড় খাটটিতে আমরা আড়াআড়িভাবে ঘুমাই। বড় ঘরটিতে আব্বা, মা ছোট তিনভাই বোনকে নিয়ে থাকেন। মেজো ভাইয়ের থাকবার জায়গা নেই বাড়িতে।

অবশ্য বড় ভাইয়ের আগের ঘরটায় থাকতে পারতেন, কিন্তু ও ঘরটা ভাইয়ের পছন্দ নয়। সে তার বন্ধু বাবু ভাইয়ের বাড়িতে বাবু ভাইয়ের সাথে ঘুমায়। বাবু ভাইয়ের আব্বা কুদ্দুস মাস্টার ছিলেন চেয়ারম্যান। তিনি এবং চাচী মেজো ভাইকে খুব আদর করতেন। তো আমি আমার ঘরে এসে হারিকেনটা একটু কমিয়ে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকি। যদি সত্যি সত্যি বিয়ে দিয়ে দেয়, তাহলে আমার পড়াশোনা!  আমার স্বপ্ন! হারিকেনের নীভু নীভু আলোর মতো একবার জ্বলে, একবার বাতাসে দোল খেয়ে এদিক ওদিক হেলে পড়ে, একবার নিস্প্রভ হয়ে চোখের সামনে সব আঁধারে ঢেকে যায়।

এরই মধ্যে একেক জন এসে একেকভাবে আমাকে ডাকে। মায়ের ঘরে যেতে বলে। যেখানে সবাই মিলিত হয়েছে সারাদিনের ঘটে যাওয়া আলোচনায়। কিন্তু আমি চুপচাপ শুয়ে থাকি। আব্বার প্রতি অভিমানে বারবার আমার চোখ ভিজে যায়। সত্যি সত্যি আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে! আমার কাছে একবারও জিজ্ঞেস করলো না? কি আমার মতামত? জীবনে আমার লক্ষ্য কী? সারাজীবন পরীক্ষার খাতা ভর্তি লিখেই গেলাম 'এইম ইন লাইফ'–বড় হয়ে আমি কী হতে চাই?

খুব ভোর করে ঘুম থেকে উঠে কল পাড়ে অনেকটা সময় নিয়ে ওজু করি। যদি কলপাড়ে আব্বাকে দেখা পাই। কিন্তু না, আব্বার দেখা পাই নি। আব্বার ঘরের দরজা ভেজানো। ভাবি, হয়তো বাথরুমে গেছে।  আমাকে ঠিক ডাকবে। নামাজ পড়ে চুপচাপ শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করি। আজ আর কোরআন শরিফ পড়ার মন নেই, ধৈর্য্য নেই। কিন্তু আব্বা আমাকে ডাকেন না। পরে জেনেছি, আব্বা ওইদিন খুব ভোরেই কাউকে কিছু না বলেই বের হয়ে গেছেন। সাধারণত কখনোই আব্বা এটা করেন না।

আমিও অভিমানে ঘর থেকে বের হই না। সারাদিন বলতে গেলে ঘরেই আবদ্ধ থাকি। প্রয়োজন ছাড়া একবারও বের হইনি। একটি দিন যেন একটি বছরের সমান। সময় আর যায় না। এক সময় সন্ধ্যা নামে, রাত গাঢ় হয়। যথারীতি ঘর অন্ধকার করেই আমার স্বভাব বিরুদ্ধ শুয়ে আছি। ভাইবোনেরা কেউ সাহস করে ডাকছে না, হেরিকেন আনছে না। ভাবী কয়েক বার ডেকেছেন।
–ওঠো, সাতটা বাজে।
–ওঠো, আটটা বাজ।
–ওঠো, রাত নয়টা বাজে। পড়তে বসো।
আমি কোনো উত্তর দেই না। চুপচাপ শুয়ে থাকি। পড়তে বসে কী হবে? আমি যখন এ বাড়িতে এতোই ভার হয়ে গেছি। আমাকে বিদায় করো।

রাত ঠিক দশটায় আব্বা আসেন ঘরে। আমাকে ডেকে তোলেন। ফরিদপুর থেকে আগের দেওয়া ফর্দ মোতাবেক প্রয়োজনীয় বড় এক বাণ্ডিল বই এনেছেন।  অ্যাপ্লাইড গ্রামার, বাংলা গ্রামার, বাংলা একাডেমির বানানরীতিসহ বেশ কিছু  প্রয়োজনীয় বই। আব্বাকে কাছে পেয়ে বইয়ের বাণ্ডিল হাতে নিয়ে এই দুই দিনের জমানো অভিমান কান্না হয়ে ঝরে পড়ে। বলি,
–বই আর কি হবে?
আব্বা আমাকে জড়িয়ে  ধরে আদর করে বলেন–বইই তো হবে মা। ওরা আমাকে কথা দিয়েছে। তোমাকে পড়াবে। যতদূর তুমি পড়তে চাও। ততোদূর তোমাকে পড়াবে। আমার এছাড়া আর কোনো শর্ত নেই। তাই তো আমি রাজি হয়েছি। ছেলেরও একটিই শর্ত। মেয়েকে পড়তে হবে। যৌতুক চায় না সে।

 "তোমার হবু শ্বশুরের সাথে আমার পাকা কথা হয়েছে, উনারা তোমাকে পড়াবেন। এই শর্তেই আমি এখন তোমার বিয়েতে রাজি হয়েছি। না হলে আমি তোমাকে এখন বিয়ে দিতাম না। আমি তো জানি, তুমি অনেক পড়াশোনা করতে চাও। যশোর শহরের  ঐ বাড়িতে পড়াশোনার খুব ভালো পরিবেশ আছে। আমি চাই, তুমি সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হও। আমি তোমার জন্য অনেক দোয়া করছি মা।"

আব্বার হাতে বইগুলো দেখে অভিমানে আমার কান্না আরও বেড়ে যায়। আমার কান্না মুছিয়ে আমাকে অনেক আদর করেন। আমার জন্য অনেক দোয়া করেন। শুধু আজকের এই দিনটিতে যে আমার আব্বার কথা মনে পড়ছে, তা নয়। প্রতিটি দিনেই আব্বা আমার সাথে আছেন, আব্বার দোয়া আমার সাথেই আছে। পৃথিবীর সব বাবার জন্য আজ আমার বিনম্র শ্রদ্ধা। পৃথিবীর সব বাবারা ভালো থাকুন।

আমার আব্বা মারা গেছেন ১৯৯৫ সালের ১৩ জুলাই। আব্বা মারা যাবার বছর সব ভাইবোন একত্র হয়ে আব্বার মৃত্যূদিবস পালন করেছি। কয়েক বছর হল নীরবে নিভৃতেই চলে যায় দিনটি। অথচ আব্বা ছিলেন আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অনুসঙ্গ। মা মারা গিয়েছেন ৭৮ সালের তের এপ্রিল।  সকাল ১০টায়। সেই থেকে আব্বা ছিলেন আমাদের মা, আমাদের আব্বা, আমাদের বন্ধু, আমাদের সহায়।

সময় শেষে তিনিও চলে গেছেন। শুধু তার শিক্ষা তার দীক্ষা তার স্বপ্ন তার মত বড় হবার আকাঙ্ক্ষা সঙ্গে আছে। থাকবে আজীবন। আমার আব্বা ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ বাবা। পৃথিবী জুড়ে তার মতন বাবা সবার হোক। বাবা তুমি ভালো থেকো।

'রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগীরা।'

লেখক পরিচিতি: ড. শাহনাজ পারভীন একাধারে কবি, গবেষক, কথাসাহিত্যিক ও গীতিকার। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গবেষণা, প্রবন্ধ, শিশুতোষ সব মিলিয়ে ২৫টি গ্রন্থের প্রণেতা। তিনি সম্পাদনা করছেন নান্দনিক ধারার সাহিত্য কাগজ ‘দ্যোতনা’এবং ছড়া সাহিত্যের কাগজ  ‘ছড়াঘর’।  দায়িত্ব পালন করছেন যশোরের সাহিত্য সংগঠন ‘অগ্নিবীণা’র কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি হিসাবেও। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। পেশাজীবনে তিনি একজন শিক্ষক, যশোরের তালবাড়ীয়া ডিগ্রি কলেজের প্রিন্সিপ্রাল হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/